IQNA

ট্রাম্পের যুগ মুসলিমদের জন্য কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষা

22:42 - January 21, 2018
সংবাদ: 2604850
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিনটি ছিল শুক্রবার। এটি মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক পবিত্র দিন। তার এই ক্ষমতা গ্রহণ আমার মনে অত্যন্ত ভীতির সঞ্চার করেছিল। কেননা আমাদের নতুন প্রেসিডেন্ট তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় মসজিদ বন্ধ করে দেয়ার এবং মুসলমানদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করার হুমকি দিয়েছিলেন। আমি জানতাম, মানুষকে এ সম্পর্কে সাহস যোগানোর জন্য আমাকে কিছু একটা বলতে হবে।

 ট্রাম্পের যুগ মুসলিমদের জন্য কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষা



বার্তা সংস্থা ইকনা: আমি অরেঞ্জ কাউন্টির ইসলামিক ইনস্টিটিউটের একজন ইমাম। এখানে আমার সম্প্রদায়ের সদস্যরা চিন্তিত ছিলেন এই ভেবে যে, ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ কিভাবে তাদের জীবন-যাত্রাকে পরিবর্তিত করবে? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী আসলেই তার প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করতে যাচ্ছে? এই ধরনের প্রশ্ন সবসময়ই তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াত।

ওই দিন সকালে আমি মসজিদের দিকে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি আর নির্বাচনের তিন দিন পর মসজিদে দেয়া একটি বক্তৃতা স্মরণ করছিলাম। নভেম্বর মাসে আমার সম্প্রদায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিল। মানুষজন নিয়মিত আমাকে জিজ্ঞাসা করত, ‘শেখ মোস্তাফা, আমাদের কি এই দেশ ছেড়ে চলে যাবার সময় এসেছে?’

মসজিদে আমার একজন মুসল্লি বন্ধু দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি আর অন্য কোথাও বাস করতে পারব না।’ আমি তাকে সাহস দিয়ে বলেছিলাম, একজন মুসলিম খারাপ সময়ের জন্য প্রস্তুতি নেয় কিন্তু একই সঙ্গে ভাল কিছুর জন্যও আশা ও প্রার্থনা করে।

ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় যে জীবন হচ্ছে আল্লাহর প্রতি মানুষের আনুগত্যের একটি পরীক্ষা এবং ট্রাম্পের নির্বাচনকে ধৈর্যের পরীক্ষা হিসাবে দেখার জন্য আমি আমার সম্প্রদায়কে পরামর্শ দিয়েছিলাম। আল্লাহ দেখতে চান যে আমরা এই চ্যালেঞ্জ সহ্য করতে পারি কিনা অথবা অভিযোগ ও হতাশার মধ্যে পড়ি কিনা।

ইসলাম ও কুরআন আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, যখন আমরা কোনো চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করি, তখন আমাদের এ থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। আমি আশা করেছিলাম, এই নির্বাচন ব্যক্তি এবং সমাজকে উন্নত করার সংগ্রামে আমাদেরকে পরিচালিত করতে পারে।

ট্রাম্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমি প্রায় ২,০০০ মুসলমানের একটি সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলাম। যেখানে তরুণ, বৃদ্ধ, স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং প্রায় দুই ডজন দেশের অভিবাসীসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিল।

আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিলাম যে একজন মুসলিম হচ্ছে ভালো চরিত্রের। মুসলমানদের অন্তরে কঠোর ভাষাকে প্রশয় দেয়া উচিত নয়। আমাদের ধর্মের কারণে যারা আমাদেরকে অপমান করে, আমরা অবশ্যই তাদেরকে অপমান করব না এবং তাদের সামনে আমরা সর্বদা আমাদের সর্বোত্তম আচরণটিই করব।

প্রতি সপ্তাহে বিরোধী-এডিটরিয়াল কলামিস্ট, টাইমস সম্পাদকীয় বোর্ড এবং সারা বিশ্বের লেখকদের উসকানিমূলক মন্তব্যের কথা ভাবুন।

সত্য হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের একটি ভিন্ন মান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন স্বামী রেস্টুরেন্টে তার স্ত্রীকে চিৎকার করতে দেখেন, তবে মানুষ মনে করতে পারে যে এটি তার জন্য একটি খারাপ দিন। কিন্তু সেই ব্যক্তিটিকে যদি একজন মুসলিম বলে মনে হয় এবং তার স্ত্রী যদি মাথায় হিজাব পরিধান করেন, তখন সেখানে উপস্থিত লোকজন ধারণা করতে পারে যে, কুরআন তাকে এভাবে আচরণ করতে বলেছে।

আমেরিকাতে মুসলিম হওয়ার বোঝাটা আজও এতো বেশি যে এই ধরনের মতবাদ দেশটির রাজনীতিবিদদের দ্বারাই ছড়ানো হচ্ছে। আমি আমার সম্প্রদায়কে বলব, এই পরিস্থিতিটি যথাযথ নাও হতে পারে, কিন্তু এটি আমাদের নিজেদের উন্নতির সুযোগ দিতে পারে।

ট্রাম্পের উদ্বোধনের পর আমাদের মসজিদে একটি চিরকুট, ফুল এবং উপহার প্রদান করা হয়েছিল। আমরা তা স্বাগত জানিয়েছিলাম। একটি কার্ডে লেখাছিল: ‘আমার আশেপাশে একটি মসজিদ থাকার ফলে এটি আমার প্রতিবেশীকে প্রকৃত আমেরিকান হতে সাহায্য করতে পারে। আমি অনেক গর্বিত এবং কৃতজ্ঞ যে আপনি এখানে আছেন। আপনি একা নন। আপনার বন্ধু আছে। আমি তাদের একজন।’

মসজিদে ধর্মোপদেশের শেষে আমি কার্ডটি জোরে জোরে পাঠ করেছিলাম এবং তা ইন্সট্রাগ্রাম ও ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। এই সাধারণ কার্ডটিই আমাদেরকে আশা যুগিয়েছিল।

তবুও, মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন নেতা হিসাবে আমি মাঝে মাঝে ইসলামোফোবিয়ার পরিবেশ দেখতে পাই; যা চ্যালেঞ্জিং বিশ্বাসীদের জন্য ট্রাম্প কর্তৃক তৈরি করা হয়েছে।

গত এক বছরে একাধিক নারী আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছে যে, হয়রানি হওয়ার আশঙ্কার জন্য তাদের হিজাব পরিহার করা উচিত কিনা। আমি তাদেরকে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারিনি; যা আমাকে দুঃখিত করেছে।

আমরা মুসলমানরা দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করি। কখনো কখনো শপিং মল বা পার্কে প্রার্থনা করতে দেখা যায়। কিন্তু আমি প্রায়ই অনেকের কাছে শুনতে পাই যে এটি করতে তারা আর নিরাপদবোধ করেন না। আমি তাদেরকে এই বলে স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি যে বিশ্বে ১.৮ বিলিয়ন মুসলিম আছে এবং তাদের মধ্যে ৯৯.৯৯ শতাংশই অত্যন্ত ভাল ও শান্তিপূর্ণ মানুষ।

জানুয়ারির শেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’ নিয়ে তার প্রথম সংস্করণটি জারি করেন। একটি মুসলিম নাগরিক অধিকার সংস্থা কর্তৃক সংগঠিত একটি প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেয়ার জন্য আমি লস এঞ্জেলেস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। সেখানে বহন করা একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘মুসলিমরা এখানেই থাকবে’।

আমাদের প্রত্যাশা ছিল সমাবেশে সম্ভবত কয়েকশ’ মানুষ উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সেখানে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। যদিও তাদের অধিকাংশই মুসলিম ছিল না। তাদের এই ধরনের সমর্থন আমার মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল এবং আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে আমরা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াতে ভালই থাকব।

অবশ্যই, গত বছরটি সবসময়ই সহজ ছিল না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়ে অনেক রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট যুক্তরাজ্যের চরমপন্থী ‘ব্রিটেন ফার্স্ট’ গ্রুপের পোস্ট করা মুসলিম বিরোধী টুইট পুনরায় টুইট করেন। গত মাসে, সুপ্রিম কোর্ট ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার একটি নতুন সংস্করণ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এই নিরুৎসাহিত সময়ে, আমাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পাওয়া বার্তাগুলো আমি স্মরণ করি এবং সম্প্রদায়ের অন্যান্যদেরকে স্মরণ করিয়ে দিই।

লেখক মোস্তফা উমার। তিনি অরেঞ্জ কাউন্টির ইসলামিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষা ও পুনর্বাসন বিষয়ক পরিচালক। নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে

captcha